ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'গুপ্ত ও প্রকাশ্য' ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কীভাবে?

ডেস্ক রিপোর্ট
  ০৯ আগস্ট ২০২৫, ২৩:৫৮

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আবাসিক হলে সব ধরনের 'প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতি' নিষিদ্ধ থাকবে বলে গতকাল শুক্রবার রাতে ঘোষণা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণার প্রতিবাদে মধ্যরাতে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানও একই কথা জানিয়েছিলেন। 
উপাচার্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, হলপর্যায়ে ১৭ তারিখের (১৭ জুলাই) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ন্ত্রিত থাকবে এবং সেটি হল প্রশাসন যেভাবে চাইবে, সেভাবে হবে। 
তবে ১৭ জুলাইয়ের সেই সিদ্ধান্তের 'ফ্রেমওয়ার্ক' কী, তা স্পষ্ট করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আবাসিক হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের চলমান দাবির বিষয়ে আলোচনা করতে আজ শনিবার বেলা ১২টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটি। তবে বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এখনো জানানো হয়নি। 
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের প্রোভস্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য আজ রাত থেকেই ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করবে প্রশাসন।'
এদিকে আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষক দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'উপাচার্য রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিতে পারেন, তবে তা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের সভায় অনুসমর্থিত হতে হবে। হয়তো প্রশাসন তা পরে পাস করিয়ে নেবে।'
তবে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি 'গণতান্ত্রিক' নয় বলে মন্তব্য রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীনের। দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'অনেক সময় আন্দোলনে দাবির মুখে উপাচার্য যে প্রতিশ্রুতি দেন, সেটা পরে সিন্ডিকেট সভায় পাস করিয়ে নেন। এটা চর্চিত প্রক্রিয়া। তবে এটা ভুল, কেননা তখন সিন্ডিকেট সদস্যদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে না। ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুসরণ হয় না।'

যে দুই দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে হল রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী। বিশেষ করে বিগত ১৫ বছর নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা, হল প্রশাসনকে অকার্যকর করে কক্ষ দখল করা, 'গণরুম-গেস্টরুম' সংস্কৃতি, ক্যান্টিনে চাঁদাবাজিসহ নানা বিষয়ে জড়িত ছিলেন।
শিক্ষার্থীরা মূলত দুটি দাবিতে আন্দোলন করছেন। প্রথমত; হলে প্রকাশ্যে ও গোপনে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করা এবং দ্বিতীয়ত; রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কমিটিভুক্তরা পদত্যাগ ও মুচলেকা প্রদান সাপেক্ষে হলে অবস্থান, অন্যথায় তাদের হল থেকে বহিষ্কার করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ও রোকেয়া হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আদিবা মুন দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ কর্মসূচিতে হলের সব মেয়েরা অংশগ্রহণ করেছেন। হলে যেন কোনো রাজনীতি প্রবেশ না করে, আমরা সে উদ্দেশেই গিয়েছি। যারা এ মতের সঙ্গে এক হয়েছেন, তারাই এসেছেন। এখানে ছাত্রীসংস্থার মেয়েরাও ছিল, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের মেয়েরাও ছিল। সর্বসম্মতিক্রমেই আমরা প্রতিবাদ করেছি।' 

ডাকসু নির্বাচনে প্রভাব কতটুকু? 

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের জন্য আলাদাভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন করেন শিক্ষার্থীরা। সাধারণত হল ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে ছাত্রসংগঠনগুলো আলাদা আলাদা প্যানেল দিয়ে থাকে। ফলে, প্রশ্ন উঠেছে হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হল সংসদগুলোর নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে কি না।
ডাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীমউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ডাকসু সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক। এখানে কেন্দ্রীয় কিংবা হল সংসদ সবক্ষেত্রেই বিষয়টি একই। প্যানেল এখানে কেবল অনানুষ্ঠানিক ধারণা, আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্যানেল নেই।'
তিনি আরও বলেন, 'সাধারণত যারা নির্বাচনে অংশ নেন, তারা কোনো না কোনোভাবে কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন। তবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আবেদন করেন। ফলে ডাকসুর সঙ্গে রাজনীতি থাক বা না থাকার বিষয়টি এক করে দেখা ঠিক হবে না।'

আন্দোলনে নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের একাধিক নেতা

গতকাল শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল ১৮টি হলে একযোগে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ও আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে এদিন বিকেল থেকেই প্রতিক্রিয়া দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন হলে বিক্ষোভ ও প্রভোস্টকে স্মারকলিপি প্রদানের মতো কর্মসূচি পালন শেষে মধ্যরাতে হলগুলো থেকে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমাও শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আজ (শুক্রবার) রাতের মধ্যে কমিটি স্থগিত না করলে, শিক্ষার্থীরা কঠোর পদক্ষেপ নেবে। 
এছাড়া বিভিন্ন হলে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকে দেখা গেছে। ওইদিন বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক আবদুল কাদের বলেছিলেন, 'চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে ছাত্ররাজনীতি ফাংশনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া ও আকাঙ্ক্ষাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়েই ছাত্ররাজনীতির কাঠামো পুনর্গঠন করতে হবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করার আহ্বান জানাই।'
এ বিষয়ে শনিবার বিকালে আবদুল কাদের দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের সাংগঠনিক অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছি৷ কিন্তু অনেকেই এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছেন এবং গতকাল রাতে আমাদের সংগঠনের সাত সদস্য পদত্যাগ করেছেন। তারা পদত্যাগ করে এ কাজগুলো করছেন।'  
সংগঠনের ওপর কী নিয়ন্ত্রণ নেই- এমন প্রশ্নের জবাবে কাদের বলেন, ''যেহেতু আমাদের অনেকেই দীর্ঘদিন হল রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার, তাই আমরা যখন নীতিগত সিদ্ধান্ত নিই, তখন সাময়িক উত্তেজনার কারণে তারা তা মানেনি। দ্বিতীয়ত, সামনে ডাকসু নির্বাচন, সেক্ষেত্রে অনেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রীক রাজনীতি বেশি করতে চান। আমাদের সংগঠনও নতুন, অনেকেই অনেক জায়গা থেকে আসছেন, সেভাবে 'গ্রুমিং' করাটাও একটা বিষয়।'' 
'তবে এর আল্টিমেট সমাধান হলো- সবাই বসে আলাপ করা, সম্মিলিতভাবে রুপরেখা দেওয়া', যোগ করেন তিনি।

অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর বক্তব্য 

এদিকে আবাসিক হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনকে একাধিকবার ফোন করেও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে ছাত্রদল আজ ক্যাম্পাসে 'তালি মিছিল' করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় এর আগেও মৌখিকভাবে অনেক ঘোষণা দিয়েছে। মৌখিক ঘোষণার ওপর আমরা আস্থা রাখতে পারি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এখন উচিত অংশীজনদের সঙ্গে বসে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি লিখিত নীতিমালা তৈরি করা। যার মাধ্যমে যে রাজনীতি করতে চাইবে না, তার অধিকার যেমন হরণ হবে না, একইভাবে যে রাজনীতি করতে চাইবে, তারও যাতে অধিকার হরণ না হয়।'
তিনি আরও বলেন, 'সংজ্ঞায়নবিহীন কোনো ঘোষণার পক্ষ নেওয়া বা বিরোধিতা করার সুযোগ থাকে না। কী নিষেধ করছেন, কতটুকও এরিয়ার মধ্যে করছেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উল্লেখ করেনি। নিষেধাজ্ঞা মানলে কী হবে, না মানলে কী হবে, এসব কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন।' 
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, প্রক্টর হল রাজনীতি নিষিদ্ধের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তার এখতিয়ার তার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে রাজনীতি নিষিদ্ধের কোনো আইনি ভিত্তি নেই। অভ্যুত্থানের পর একটি নৈতিক অবস্থান তৈরি হয়েছিল, কিন্তু গত এক বছরে ইসলামী ছাত্রশিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সেই অবস্থানকে নষ্ট করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন যে অবস্থান থেকে হল রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, সেটি কার্যকর কোনো সমাধান নয়। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে কীভাবে রাজনীতি পরিচালিত হতে পারে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো প্রয়োজন।'

তথ্য সূত্র: টিবিএস বাংলা