মামলা তদন্তের ক্ষমতা চেয়েছে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তারা এর বিরোধিতা করে বলেছেন, র্যাবকে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো নয়। এপিবিএনকেও তদন্তের ক্ষমতা দিলে সেটি হবে ভুল সিদ্ধান্ত।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই মতামত তুলে ধরেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
অনুষ্ঠানে ডেডিকেটেড ইউনিট থাকার পরও ফুট পেট্রোলিং এবং মাদকবিরোধী অভিযানের মতো ছোট কাজে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত র্যাব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও উঠেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
‘আমার পুলিশ, আমার দেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্যে চলছে পুলিশ সপ্তাহ-২০২৫। পুলিশ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন বুধবার সকাল থেকে নিজ নিজ ইউনিটের কর্মকাণ্ড, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রেজেন্টেশন দেন পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান। এগুলো হলো অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), র্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্যুরিস্ট পুলিশ, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ), হাইওয়ে পুলিশ, এপিবিএন, রেলওয়ে পুলিশ, নৌপুলিশ ও শিল্পাঞ্চল পুলিশ। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
অন্যান্য ইউনিটের প্রেজেন্টেশনের ওপর তেমন কোনো সমালোচনা না হলেও র্যাবের বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। আলোচনার বড় অংশজুড়েই এলিট ফোর্স হিসেবে র্যাবের ব্যর্থতার বিষয়গুলো উঠে আসে। প্রায় সব ইউনিটই মামলার তদন্ত ব্যয়, অভিযানের খরচ, অজ্ঞাত লাশ ব্যবস্থাপনার অর্থ, অপ্রতুল জনবল এবং অন্যান্য কাঠামোগত সংকট ও সাফল্যের কথা তুলে ধরে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, প্রেজেন্টেশনের ওপর অংশ নিয়ে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনা করেন। র্যাবকে ‘বিতর্কিত’ এবং ‘কলঙ্কিত’ উল্লেখ করে এক কর্মকর্তা বলেন, র্যাবে পদায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাহিনীর যে আনুপাতিক হার নির্ধারণ করা আছে, তা মানা হচ্ছে না।
অন্য এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, র্যাবের জনবল বিভিন্ন বাহিনী থেকে পদায়ন হওয়ায় তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে। এই সমন্বয়হীনতা রোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম এবং খুনের সঙ্গে যেসব র্যাব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না এ বিষয়টিও জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্ন করা হয় র্যাবের আয়নাঘর সম্পর্কেও।
পুলিশের একজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বলেন, র্যাব একটি এলিট ফোর্স। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এলিট ফোর্সগুলো যে ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে, র্যাব এর ধারে-কাছেও যেতে পারছে না। আসল কাজ বাদ দিয়ে র্যাব অনেক ‘খুচরা’ কাজ করছে। র্যাব কেন ফুট পেট্রোলিং করবে? তারা কেন মাদকবিরোধী অভিযানে যাবে? এসব কাজের জন্য তো ডেডিকেটেড ইউনিট আছে। র্যাব তৈরি করা হয়েছিল বড় বড় অভিযান পরিচালনা করার জন্য। পুলিশ যখন কোনো কাজ পারবে না, সেই কাজটি করবে। কিন্তু এটা করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে।
এসব প্রশ্নের জবাবে র্যাবের ডিজি বলেন, ‘আমরা সাধারণত খুচরা কাজ করি না। তবে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইজিপির নির্দেশে ফুট পেট্রোলিংসহ বেশকিছু ছোটখাটো কাজ আমরা করেছি।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে পুলিশের ডিআইজি (প্রশাসন) কাজী মো. ফজলুল করিম বলেন, পুলিশের বাজেটের বড় একটি অংশ ব্যয় হচ্ছে র্যাবের পেছনে। কিন্তু সে অনুযায়ী আউটপুট পাওয়া যাচ্ছে না।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তা বলেন, শোনা যাচ্ছে, রাজনৈতিক সরকার এলে র্যাব বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে র্যাবের জনবল, সম্পদ এবং স্থাপনা কীভাবে কার কাছে হস্তান্তর করা হবে, এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
জবাবে র্যাবের ডিজি এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, র্যাব বিলুপ্ত হলে সরকার যে সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গুম-খুন সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, অতীতে অনেক গুম-খুন হয়েছে। সেগুলো নিয়ে গুম কমিশন তদন্ত করছে। ৫ আগস্টের পর র্যাব কোনো গুম-খুনে জড়ায়নি।
এপিবিএনের প্রেজেন্টেশনে ব্যাটালিয়ন সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। উপস্থাপনায় বলা হয়, তারা মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণার ৯২ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে। এ বিষয়টি উল্লেখ করে, ভবিষ্যতে মামলার তদন্ত ক্ষমতা চান তারা। পাশাপাশি সব ব্যাটালিয়নে সমপরিমাণ জনবল (৮৫০ জন করে) দাবি করেন।
এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব দেওয়ার নির্দেশ দেন আইজিপি। এ সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রতারণার টাকা উদ্ধার করা এপিবিএনের কাজ নয়। তাদের তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, তারা অপারেশনাল ফোর্স। অপারেশনাল ফোর্স র্যাবকে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
আইজিপির দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, এপিবিএনকে যদি তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয় তাহলে সেটি হবে একটি ভুল সিদ্ধান্ত।
ওই কর্মকর্তা বলেন, আইজিপি হলেন পুলিশের সারাদেশের চিফ ইনভেস্টিগেশন অফিসার। তদন্তের জন্য পুলিশের অনেকগুলো ইউনিট আছে। একটি ইউনিট তদন্তে সফলতা দেখতে না পারলে তিনি যে কোনো ইউনিটকেই তদন্তের নির্দেশ দিতে পারেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের উপস্থাপনায় বলা হয়, ঈদের সময় কক্সবাজারে ৮ থেকে ১০ লাখ লোকের সমাগম হয়। কিন্তু সেই তুলনায় সেখানে ট্যুরিস্ট পুলিশের জনবল খুবই কম।
পিবিআইয়ের প্রেজেন্টেশনে মামলা তদন্তের সফলতার হারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
সিআইডির উপস্থাপনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নানান সাফল্য ও অর্জন তুলে ধরা হয়। বলা হয়, আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে এখন অপরাধ তদন্ত আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করছে সিআইডি। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে সিআইডি। সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের অজানা সম্পদের উৎস খুঁজতে গঠিত এই কমিটি ইতোমধ্যে হাজার কোটি টাকার সম্পদ শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৮০০ শতাংশ জমি।
সিআইডির প্রেজেন্টেশনে আরও বলা হয়, এস আলম, বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, নাবিল, ইউনিক, সিকদার গ্রুপসহ বড় বড় করপোরেট গ্রুপের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মামলা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কক্সবাজারের একটি মামলায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এসব তথ্য উপস্থাপনায় ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কার্যক্রম বড় পরিসরে করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।
এছাড়া ফরেনসিক শাখার অগ্রগতি নিয়েও তথ্য উঠে আসে সিআইডির প্রধানের উপস্থাপনায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএ, ডিজিটাল ও কেমিক্যাল ফরেনসিকের মাধ্যমে বহু ক্লুলেস মামলার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করা হয়। চাঁদপুরের মেঘনায় সাত খুন, ঝালকাঠিতে যুবক হত্যা ও বাড্ডায় চুরির ঘটনা উদ্ঘাটনে ফরেনসিক প্রযুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখে।
রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন অডিটোরিয়ামে বুধবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে পুলিশ ও তাদের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশের ফেসবুক পেজরাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে বুধবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে পুলিশ ও তাদের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা। ছবি: বাংলাদেশ পুলিশের ফেসবুক পেজ
সিআইডির সাফল্যের মধ্যেও রয়েছে তীব্র সংকট ও সীমাবদ্ধতা। যানবাহনের অভাব, তদন্তের খরচ, নিজস্ব স্থাপনার অভাব, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের ঘাটতির পাশাপাশি আছে বদলির অনিশ্চয়তা। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবগুলোর প্রযুক্তি উন্নয়নে নেই প্রয়োজনীয় বাজেট। মাঠ পর্যায়ে ল্যাব না থাকায় অনেক সময় তদন্ত বিলম্বিত হয়।
অন্যান্য ইউনিটও নিজেদের সাফল্যের পাশাপাশি বিভিন্ন দাবি তোলে। এর মধ্যে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানো, দাফন ও সৎকারের জন্য তহবিল, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাধীন সাইবার ইউনিট গঠন, পুলিশ মেডিকেল কলেজ স্থাপন, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ এবং অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানান তারা।
এছাড়া পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ উদ্যাপন উপলক্ষে বুধবার রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, সচিবদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, পুলিশের মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে পুলিশের অনন্য ভূমিকার প্রশংসা করেন।