
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ১২০ দিনের মধ্যে তাদের কাজ সম্পন্ন করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এসময়ে ১৪০০ জনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে কমিশন। গণমাধ্যমের (সংবাদপত্র টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়া) সমস্যা নিরূপণ ও বিদ্যমান সংকট নিরসনে কি করা প্রয়োজন সে সম্পর্কে ২০টি সুপারিশ করেছে কমিশন।
শনিবার (২২ মার্চ) দুপুরে রাষ্ট্রীয় ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা বলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ।
কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গত বছরের ১৮ নভেম্বর গঠিত হয়েছিল। প্রথমে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল পরে আরও ৩০ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল। ১২০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করেছে কমিশন। এসময়ে সারাদেশের অংশীজনের (মালিক, প্রকাশক ও সম্পাদক, সাংবাদিকদের সংগঠনের প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন) আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময় সভা করেছে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে নয়টি জেলার সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়। মোট এক হাজার ৪০০ জনের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকটের মধ্যে রয়েছে। বর্তমান যে বাস্তব অবস্থা তা একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘদিনের ক্রমাবনতির ফলে তৈরি হয়েছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সমূহ:
ঢাকার সাংবাদিকদের জন্য ‘ঢাকা-ভাতা’ চালুর সুপারিশ:
জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়ায় ঢাকার সাংবাদিকদের জন্য ‘ঢাকা-ভাতা’ চালুর সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। তবে, ঢাকা-ভাতার টাকার পরিমাণ কি হবে তা নির্ধারণ করবেন সরকার ও গণমাধ্যমের নীতিনির্ধারকরা।
সাংবাদিকদের ন্যূনতম বেতন বিসিএস নবম গ্রেডের মতো দেওয়ার সুপারিশ:
কামাল আহমেদ বলেন, বস্তুনিষ্ঠ, স্বাধীন ও শক্তিশালী সংবাদমাধ্যম নিশ্চিত করতে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা প্রয়োজন। এ লক্ষ্য বেতন-ভাতা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে ওয়েজ বোর্ড (মজুরি বোর্ড) নিয়ে আবেগ আছে। এ ওয়েজ বোর্ড নিয়ে একটি মামলার কারণে তা ঝুলে আছে। এটি পুরোপুরি আদালতের বিষয় হওয়ায় মামলা কবে নিষ্পত্তি হবে তা অজানা। এর আগে ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা হয়েছিল তা ১০ বছর হয়ে গেছে। এ কারণেই বিসিএস ক্যাডারদের এন্টি লেভেলের নবম গ্রেডের বেতন স্কেল অনুযায়ী সাংবাদিকদের এন্ট্রি লেভেলও দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রেস কাউন্সিল খুব একটা কার্যকর নয়:
প্রেস কাউন্সিল খুব একটা কার্যকর নয় বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, প্রেস কাউন্সিলকে জাতীয় স্থায়ী গণমাধ্যম কমিশনের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব করেছে কমিশন।
কামাল আহমেদ বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেক সময় ভুল সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ আসে। সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের কাছে হয়রানির শিকার হন। যার ফলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ থেকে প্রতিকার পাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
তিনি বলেন, একটা প্রেস কাউন্সিল ছিল, এখনো আছে, কিন্তু সেটা খুব একটা কার্যকর না। থাকলেও তা যেমন সাংবাদিকদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না, তেমনি ভুক্তভোগী যারা গণমাধ্যমের অন্যায় কাজের শিকার হন, তাদের প্রতিকার দিতেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।
কমিশন প্রধান বলেন, প্রেস কাউন্সিলের আরও একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রেস কাউন্সিল আইনটি শুধু সংবাদপত্র ও বার্তা সংস্থার সাংবাদিকদের জন্য হয়েছিল। কিন্তু এখন তো টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকতার একটি বিরাট অংশ। তাহলে এদের তদারকি প্রতিষ্ঠান কে হবে?
কামাল আহমেদ আরও বলেন, ২০১৪ সাল থেকে সরকারি একটি প্রস্তাব ছিল সংবাদপত্র টেলিভিশন ও অনলাইনে জন্য একটি সম্প্রচার কমিশন করবে। সেই সম্প্রচার কমিশন হয়নি। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন একটি জাতীয় স্থায়ী গণমাধ্যম কমিশন গঠন করে প্রেস কাউন্সিলকে এর সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব করেছে।
তিনি বলেন, জাতীয় গণমাধ্যম কমিশন সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি গণমাধ্যমের ভুলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন তাদের প্রতিকার দেওয়ার কাজটাও করবে।
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল বিদেশে দেখাতে ব্যবস্থা নেবে সরকার:
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি এবং আগ্রহী বিদেশিরা দেখতে পারেন- সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকার নেবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, দেশীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একটি নির্দিষ্ট স্যাটেলাইট ব্যবহারে বাধ্য বলে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখা যায় না।
কমিশনের পক্ষ থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি এবং আগ্রহী বিদেশিরা দেখতে পারেন- সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।
এদিন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদসহ অন্য সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাতে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।
কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক জাহিদ, অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন ওনার্স (অ্যাটকো) প্রতিনিধি মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সচিব আখতার হোসেন খান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি ফাহিম আহমেদ, মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির, ডেইলি স্টারের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ডেপুটি এডিটর টিটু দত্ত গুপ্ত এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুন।
গণমাধ্যমে কালো টাকা ঢুকেছে: কামাল আহমেদ:
ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ
গণমাধ্যমে কালো টাকা ঢুকেছে বলে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ। এছাড়া গণমাধ্যমের মালিকানা সমস্যা একটি বড় সমস্যা বলে জানান তিনি।
কমিশন প্রধান বলেন, কারা মালিক হয়েছেন, কী পদ্ধতিতে হয়েছেন তা অজানা। কারণ কোনো প্রকাশ্য, উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টেলিভিশন ও রেডিওর লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। অনলাইনের নিবন্ধনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সবগুলোর অনুমোদন রাজনৈতিক পরিচয়ে, নেপথ্যে ও যোগসাজশে দেওয়া হয়েছে।
কামাল আহমেদ বলেন, সরকার পরিবর্তন হলেও মালিক পরিবর্তন হয়নি। নিউজরুমের নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়েছে। সম্পাদকের নেতৃত্বে পরিবর্তন হয়েছে। পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসতে পারে তাদের সঙ্গে মালিকরা যোগাযোগ স্থাপন করছেন।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের মালিকদের বিনিয়োগের উৎস কী, সে সম্পর্কে কাউকে জবাব দিতে হয়নি। সেগুলো কী করযোগ্য নাকি কর দেওয়া হয়নি, এরকম কিছুই বলা হয়নি।
টেলিভিশনের মালিকানা যারা পেয়েছেন তাদের অনুমতির আবেদনপত্রে জনস্বার্থ বিষয়ক স্টেটমেন্ট কিছুই ছিল না। যা ছিল শুধু রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রচারণার অঙ্গীকার।
কমিশন প্রধান বলেন, গণমাধ্যমের মালিকদের কোনো জবাবদিহি নেই। আমরা গণমাধ্যম থেকে রাজনীতিবিদ ও আমলাদের জবাবদিহি চাই, কিন্তু গণমাধ্যমের জবাবদিহি কোথায়?
তিনি বলেন, একটা পত্রিকা আরেকটা পত্রিকার মালিকের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করছে। এ রিপোর্ট কি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নাকি একেবারেই ব্যক্তিগত স্বার্থের, এসব প্রশ্ন আমরা বিবেচনা করে দেখেছি।
বড় ও মধ্যম মানের গণমাধ্যমকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করার সুপারিশ:
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, বড় ও মধ্যম মানের গণমাধ্যমকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এর মাধ্যমে বাজারে শেয়ার ছাড়া এবং সাংবাদিক-কর্মচারীদের সেই শেয়ারের অংশীজন বানানোর সুযোগ তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।
কামাল আহমেদ বলেন, আমরা ক্রস ওনারশিপ বন্ধ করার প্রস্তাব করেছি। গণমাধ্যমের মালিকানা একক হাতে গেলে তা ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। নিজস্ব গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা।