রাজশাহীর সাংবাদিক মহলে এক পরিশ্রমী ও বিনয়ী নারী সাংবাদিকের নাম মাসুমা ইসলাম। বিভাগীয় এই শহরে টেলিভিশনে কাজ করা একমাত্র নারী সাংবাদিক তিনিই। কর্মক্ষেত্রে সর্বোচ্চটা দিয়ে পাঠক মনে জায়গা করেছিলেন মাসুমা। অনলাইন সাংবাদিকতায় হাতেঘড়ি হলেও সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল এখন টেলিভিশন।
মাসুমার বাবা আব্দুর জব্বার সাবেক সেনা সদস্য। মাসুমারা দুই ভাই-বোন। বাবা-মা ও একভাই মিলে বাবার সংসারে তারা চারজন। মাসুমার বড় ভাই একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। মাসুমার স্বামী রাজশাহীতে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন। মাসুমার শ্বশুর বাড়ি কুমিল্লায়।
জানা গেছে, মাসুমা ইসলাম এখন টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো অফিসের রিপোর্টার ছিলেন। মাসুমার গ্রামের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুর ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামে। সেই সুবাদে তিনি নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপরে প্রাথমিকের ধাপ পেড়িয়ে গুরুদাসপুর বেগম রোকেয়া বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষে বিল চলন শহিদ শামসুজ্জোহা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ করেন।
এরপরে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য আসেন বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। রাজশাহীর নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অর্নাস-মাস্টাস করেছেন তিনি। তিনি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নবম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। শিক্ষাজীবন থেকেই তার সাংবাদিকতার শুরু। পরে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন।
সাংবাদিকতার শুরুতে মাসুমা ইসলাম কাজ করেছে ‘নিউজ রাজশাহী’ নামের একটি অনলাইন পোর্টালে। সেখানে কিছুদিন কাজের পরে তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘বাংলার জনপদে’ যোগ দেন রিপোর্টার হিসেবে। রাজশাহীর এই অনলাইনটিতে থাকাকালীন সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়া কনন্টেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। অনলাইন নিউজ পোর্টালটিতে দুই বছর কাজ করেছেন মাসুমা। এ সময় রিপোর্টার থেকে পদোন্নতি পেয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে চিফ-রিপোর্টার হন তিনি। এরপরে ২০২৪ সালে এখন টেলিভিশনের রাজশাহী ব্যুরো অফিসের রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ পান মাসুমা।
২০২৩ সালের শেষের দিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেন তিনি। সেই স্বামীর সঙ্গে রাজশাহীতেই থাকতেন তিনি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গেল ১৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় শ্বশুরবাড়িতে স্বামীসহ বেড়াতে যাচ্ছিলেন। এ সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নূরজাহান হোটেলের উল্টোদিকে বাস থেকে নেমে সিএনজি ঠিক করার সময় দ্রুতগামী একটি বাস তাদের ধাক্কা দেয়।
এতে ঘটনাস্থলে সিএনজি অটোরিকশার চালক ও মাসুমা আক্তার ও তার স্বামী গুরুতর আহত হন। প্রথমে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসায় উন্নতি না হলে তাকে নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে মাসুমা ইসলাম না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় রাজধানীর বাবর রোডের মারকাজুল ইসলামে প্রথম জানাজা শেষে বিকেল সাড়ে চারটার দিকে গ্রামের বাড়ি নাটোরের গুরুদাসপুরে পোঁছায় সাংবাদিক মাসুমার মরদেহ। সেখানে বিকেল সাড়ে ৫টায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে গুরুদাসপুর পৌর সদরের নারয়াণপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
দুপুরে গ্রামের বাড়িতে মাসুমার মরদেহ আসার খবরে প্রতিবেশী ও স্বজনরা ভিড় করে। এ সময় আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে চারপাশ। মাসুমাকে হারানোর বেদনায় স্বজনরা অতীতের কথা তুলে বিলাপ করতে থাকেন। শেষবারের মতো মাসুমাকে দেখতে তার সাবেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও এসেছিলেন সহপাঠীরাও। শেষ বিদায় দিতে তার কর্মস্থল রাজশাহী থেকেও গিয়েছে বিভিন্ন মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকরা।
মাসুমার সাবেক সহকর্মী জাহিদ হাসান সাব্বির বলেন, রাজশাহী তাকে ভুলবে না। চিরকাল রাজশাহীর সাংবাদিকতায় আপা রবেন। শেষ হয়েও হইলো না শেষ। আপুকে অনেক মিস করব।
মাসুমার কয়েকজন শিক্ষক জানান, পড়াশোনায় ভালো ছিল মাসুমা। সব সময় বড় কিছু হওয়ার আকাঙ্খা ছিল তার মধ্যে। কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল রাজশাহীতে। তখন মাসুমা জানাল স্যার আমি রাজশাহীতে টেলিভিশনে সাংবাদিকতা করছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।
বাড়িতে মাসুমার মরদেহ আসার পরে বিলাপ করতে করতে মা রেহেনা বেগম বলেন, আমার মেয়ে চাকরি পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিল। মাসুমা বলতো- অনেক বড় চ্যানেলে চাকরি পাইছি আম্মু, তুমি চিন্তা কইরো না। মেয়ে আমারেক ছেড়ে গেল, এখন কি নিয়ে থাইকবো।’
এখন টিভির রাজশাহী ব্যুরো প্রধান রাকিবুল হাসান রাজিব জানিয়েছেন, বাদ আসর গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে মাসুমার মরদেহ দাফন করা হয়েছে। মাসুমা ইসলাম ছিলেন পরিশ্রমী ও বিনয়ী। মাসুমার অকাল মৃত্যুতে রাজশাহীর সাংবাদিক সমাজে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।